আমরা অনেকেই ইদানিং ভেন্টিলেটর নিয়ে কাজ করছি। একজন মানুষ যখন নিজে নিজে নিঃশ্বাস নেবার সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলে, তাকে জীবন বাঁচাতে তখন ICU তে Ventilator এর মাধ্যমে অক্সিজেন দিয়ে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। দুঃখের বিষয় হলো, ICU Ventilator সহজলভ্য নয়, অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও জটিল একটি যন্ত্র। সাধারণত ভেন্টিলেশন এর কাজটি ইনভ্যাসিভ (Invasive) অর্থাৎ গলায় টিউব ঢুকিয়ে অক্সিজেন দিতে হয় যা অত্যন্ত স্পর্শকাতর। যতটুকু শুনেছি, বাংলাদেশের অনেক ডাক্তারও ICU Ventilator চালনার ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান রাখেন না!
করোনা পরিস্থিতি প্রকট হবার সাথে সাথেই পুরো পৃথিবীতে কীভাবে কম খরচে এবং সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে ব্যাপক আকারে ভেন্টিলেটর উৎপাদন করা যায় তা নিয়ে একদল গবেষক এবং উদ্ভাবক কাজ শুরু করে। গর্বের বিষয় হল, আমাদের দেশেও বেশ কিছু স্টুডেন্ট গ্রুপ, স্টার্টআপ এবং বড় কোম্পানীও এক্ষেত্রে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং অনেকে প্রোটোটাইপও তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের প্রচেষ্টাকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাই এবং এতে কোন কারিগরি সাহায্য লাগলে আমার অবস্থান থেকে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করতে চাই।
কিন্তু বাস্তবতার নিরীখে পরখ করতে যেয়ে আমার চোখে বেশ কিছু বিষয় ধরা পরেছে। প্রায় তিন লক্ষ টাকা এবং ক্ষেত্র বিশেষে আরো কয়েকগুণ মূল্যের অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং জটিল একটি যন্ত্র কি আসলেই এত দ্রুত, নামমাত্র খরচে নির্ভরযোগ্য ভাবে বানিয়ে ফেলা যায়?
আমি ব্যক্তিগতভাবে গত ৫-৭ বছরের ইলেক্ট্রনিক প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট এবং ম্যানুফ্যাকচারিং এর সাথে যুক্ত থেকে বলতে পারি বিষয়টি মোটেও সহজসাধ্য না। প্রোটোটাইপ থেকে প্রোডাক্টে যাবার পথটি অনেক লম্বা । প্রয়োজন হয় অনেক মানুষের অনেক দিনের গবেষণা। অসংখ্যবার পরিবর্তিত হয় মূল ডিজাইন এবং আর্কিটেকচার। পার হতে হয় অনেকগুলো ফিল্ড টেস্ট। আর একটি মেডিক্যাল ডিভাইস, যেটি মানুষকে মুমূর্ষু অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখবে সেটির ক্ষেত্রে এ ব্যাপারগুলো আরো অনেক বেশী জটিল এবং সূক্ষ্ম।
আমাদের “টিপসই” নামক বায়োমেট্রিক ডিভাইসটি আমরা বানানো শুরু করি প্রায় ৫ বছর আগে, মার্কেটে আছে ৩ বছরের বেশী সময়। এখনো আমাদের R&D টীমকে কারিগরি জটিলতা সমাধান করতে হয় এবং নতুন ফিচার ডেভেলপমেন্ট তো আছেই। চিন্তা করে দেখেন, আপনার হ্যান্ডসেট এবং কম্পিউটারে এখনো আপডেট আসে বা ওএস আপগ্রেড হয়। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটি বায়মেট্রিক ডিভাইস বা ফোনের কারিগরি সমস্যা আর একটি মেডিক্যাল ডিভাইসের সমস্যা মোটেও এক বিষয় না।
কিন্তু তাই বলে কি আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকব? ব্যাপারটি মোটেও এমন নয়। এই প্রসঙ্গে কি করা যায় সেই আলোচনায় আসা যাক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)‘র দেয়া তথ্য অনুযায়ী, করোনা আক্রান্তদের লক্ষণ অনুযায়ী ৩টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যেতে পারে।শতকরা ৮০% করোনা আক্রান্ত রোগীর খুব মৃদু লক্ষণ প্রকাশ পাবে, তাঁদের চিকিৎসার জন্য হয়তো হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হবে না। নিজ আবাসস্থলে থেকে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চললে ২ সপ্তাহের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবার কথা। এদেরকে বলা হচ্ছে মাইল্ড (Mild ill)।
৫% রোগী খুবই সংকটাপন্ন অবস্থায় যাবে, যাদের বলা হচ্ছে ক্রিটিক্যাল (Severely ill)। এদের বাঁচানোর জন্য ICU তে নিতে হবে, ভেন্টিলেটর সাপোর্ট দিতে হবে। পরিসংখ্যান বলে, ICU তে যাওয়া ক্রিটিক্যাল রোগীদের অর্ধেকই জীবন নিয়ে ফেরত আসতে পারেন না!
এখন, বাকী যে ১৫%, এদেরকে বলা হচ্ছে Semi-Critical. এদেরকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। সংকটাপন্ন অবস্থায় যাওয়ার আগে বেশীরভাগ রোগীই এই স্টেজে থাকেন! সংকটজনক অবস্থার দিকে যেতে থাকলে রোগীকে ICU তে স্থানান্তর করে Ventilation এ রাখতে হয়। সময়মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পারলে তাদের বেশীরভাগকেই ICU সাপোর্ট এ না গিয়েই সুস্থ করে তোলা সম্ভব!
এখন, এই যে ১৫%, এই সংখ্যাটিও কিন্তু অনেক। আমরা যদি এই ১৫% সেমি-ক্রিটিক্যাল রোগীকে ICU তে যাওয়া ঠেকাতে পারি, তাহলেও কিন্তু অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব। আর এক্ষেত্রে Ventilator এর একদম প্রাইমারী লেভেলের ভার্সন BiPAP অথবা CPAP মেশিন বেশ কার্যকরী হতে পারে।
BiPAP/CPAP মেশিন কি?
BiPAP/CPAP মেশিন বাতাসকে বিশুদ্ধ করে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা সহ নির্দিষ্ট সম্মুখ চাপে (Positive Airway Pressure) সরবরাহ করে, যা শ্বাস-কস্টের রোগীকে নিঃশ্বাস নিতে সহায়তা করেI এ যন্ত্রগুলোর মাধ্যমে রোগীকে বায়ু সরবরাহ করা হয় ফেস-মাস্ক এর মাধ্যমে, যাতে গলায় টিউব প্রবেশ করাবার প্রয়োজন হয়না। প্রয়োজনে অক্সিজেন মিশ্রিত বাতাস সরবরাহ করা যেতে পারে।
CPAP মেশিন হলো Constant Positive Airway Pressure আর BiPAP হলো Bi-level Positive Airway Pressure মেশিন। BiPAP মেশিন রোগীর নিঃশ্বাসের উঠানামার সাথে সম্মুখ বাতাসের চাপও সমন্বয় করে নিতে পারে। এতে শ্বাস-কস্ট অনুভব করা রোগীর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস সহজতর হয়, যা ধীরে ধীরে রোগীর শ্বাস-কস্ট কমিয়ে তাঁকে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস অবস্থায় নিয়ে আসতে পারে।
ICU ভেন্টিলেটর এর মতো এগুলোর ব্যবহার অতি-সূক্ষ্ণ ও জটিল নয়, গলায় বাতাস/অক্সিজেন টিউব প্রবেশের প্রয়োজন নেই বিধায় এটাকে বলা হয় নন-ইনভেসিভ টাইপ (Non-Invasive)। মানুষ নিজের বাসায় ও অনেকে এই যন্ত্র রাখে, যাদের শ্বাস-কস্টের সমস্যা থাকে। এর পরিচালনাও সহজ। এবং দামও একটি ICU ভেন্টিলেটর এর তুলনায় অনেক কম (৫০-৬০ হাজার টাকা রেঞ্জ এ)।
আমরা যারা ভেন্টিলেটর বানাতে কাজ করে যাচ্ছি, তারা চেষ্টা করলে হয়তো BiPAP কিংবা অন্তত CPAP মেশিন বানানো সম্ভব।
BiPAP কিংবা CPAP মেশিনের মতোই একই ধরণের কনসেপ্ট এর, আরো সহজ মেকানিজমের আরেকটি যন্ত্র তৈরী করা যায় আমাদের স্বাস্থ্য-কর্মীদের জন্য।
এর নাম হলো PAPR (Powered Air Purifying Respirator)।
এটাও অনেকটা CPAP এর মতো, বিশুদ্ধ বাতাস দেয়, Air-tight হেলমেট এর মাধ্যমে এটা ডাক্তার-নার্সদের সংক্রমনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এবং, এটার যন্ত্রপাতিও (ফ্যান, পাইপ, হেলমেট, ব্যাটারি) হয়তো দেশেই এরেঞ্জ করা সম্ভব।
ইতোঃমধ্যে আমেরিকার FDA থেকে Ventilator স্বল্পতায় বিকল্প হিসেবে BiPAP/CPAP ব্যবহারের অনুমতি/পরামর্শ দেয়া হয়েছেঃ
চায়নার উহানের ক্রাইসিস-টাইমেও সরকার ১৪,০০০ টি Non-Invasive ভেন্টিলেটর সরবরাহ করে। সরবরাহকারী একটি কোম্পানীর ওয়েবসাইটেই সেটা লেখা আছেঃ
https://www.yuyue.com.cn/covid-19.html
উচ্চাভিলাষী ICU ভেন্টিলেটর নামক মরীচিকার পেছনে না দৌড়িয়ে আমরাও কি বাস্তব কিছু পরিকল্পনার পেছনে সময় দিতে পারি না?
আমাদের বড় বড় কোম্পানীগুলোর কেউ কেউ এই ১৫% সেমি-ক্রিটিক্যাল রোগী আর যুদ্ধ করে যাওয়া স্বাস্থ্য-কর্মীদের নিয়ে কাজ করলেও কিন্তু দেশের অনেক উপকার হয়।